সীতাকুণ্ডের কুমিরায় ‘কুমারীকুণ্ড’ শক্তিপীঠের সন্ধান মিলেছে
কুমারীকুণ্ড বাংলাদেশের চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরা খালের নিকট অবস্থিত। এই কুণ্ডটি একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। তন্ত্র বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থে এই কুণ্ডকে কন্যাশ্রম শক্তিপীঠ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।[১] মূল মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও এই কুণ্ডটি হিন্দু ভক্তদের জন্য এখনও একটি পবিত্র স্থান এবং একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম পীঠস্থান।
ইতিহাস:-
কিংবদন্তি অনুসারে, সত্য যুগের কোনও এক সময়ে মহাদেব শিবের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দক্ষ রাজা এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। কন্যা সতী (দেবী) তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে 'যোগী' মহাদেবকে বিবাহ করায় রাজা দক্ষ ক্ষুব্ধ ছিলেন।দক্ষ রাজা মহাদেব ও সতী দেবী ছাড়া প্রায় সকল দেব-দেবীকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। মহাদেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সতী দেবী মহাদেবের অনুসারীদের সাথে নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। কিন্তু সতী দেবী আমন্ত্রিত অতিথি না হওয়ায় তাকে যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া হয়নি। অধিকন্তু দক্ষ মহাদেবকে অপমান করেন। সতী দেবী তার স্বামীর প্রতি পিতার এ অপমান সহ্য করতে না পেরে যোগবলে আত্মাহুতি দেন। শোকাহত মহাদেব রাগান্বিত হয়ে দক্ষের যজ্ঞ ভণ্ডুল করেন এবং সতী দেবীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী তান্ডব নৃত্য শুরু করেন। এতে করে ধ্বংসলীলা শুরু হয় সমগ্র বিশ্বে। প্রলয় থামাতে ভগবান বিষ্ণু সতী মাতার দেহ সুদর্শন চক্রের সাহায্যে ছেদন করেন। মা সতীর দেহখণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে পড়ে, এবং স্থানগুলো পরবর্তীতে পবিত্র পীঠস্থান তথা শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিতি পায়।[২] পীঠনির্ণয়তন্ত্রে উল্লেখ আছে "কন্যাশ্রমে চ পৃষ্ঠং মে নিমিষো ভৈরবস্থথা সর্বানী দেবতা তত্র" অর্থাৎ দেবী সতীর পৃষ্ঠদেশ পতিত হয়েছিল কন্যাশ্রম স্থানে। দেবীর নাম সর্বানী ভৈরবের নাম নিমিষ।
কুমারীকুণ্ড শক্তিপীঠ:-
কন্যাশ্রম শক্তিপীঠের অবস্থান নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলেন দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের কন্যাকুমারী মন্দিরে এই শক্তিপীঠ অবস্থিত। আবার কারো মতে প্রাচীন ভারতে কনৌজ শহরের প্রাচীন নাম ছিল কন্যাকুব্জ, সেখানেই দেবীর কন্যাশ্রম শক্তিপীঠ অবস্থিত। কিন্তু বেশিরভাগ পন্ডিতের মতে এই শক্তিপীঠ বাংলাদেশের কুমারীকুণ্ডে অবস্থিত। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে কাব্যে এ বিষয়ে কিছু পাওয়া যায় না। শিবচরিত শাস্ত্র মতে বৈবস্বতের দেশে দেবীর পৃষ্ঠদেশ পতিত হয়। জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাস তাঁর অভিধানে শিবচরিতের মত মেনে নিয়ে বলেছেন বৈবস্বত শব্দের অর্থ সূর্য তনয়। সূর্য যেহেতু পূর্ব দিকে উদিত হয়, তাই ভারতবর্ষের পূর্বে অবস্থিত বাংলাদেশেই এই পীঠের অবস্থান হবে। সতীপীঠ গবেষক ডঃ দীনেশ চন্দ্র সরকারের মতে সীতাকুণ্ডের কুমারীকুণ্ডই কন্যাশ্রম শক্তিপীঠ। বারাহী তন্ত্রে উল্লেখ আছে চন্দ্রনাথ মন্দিরের পঞ্চক্রোশ দূরত্বের মধ্যেই কুমারীকুণ্ড শক্তিপীঠ অবস্থিত। বিখ্যাত তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ তাঁর বৃহৎ তন্ত্রসার গ্রন্থে কুমারীকুণ্ডের কথা উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন এই পীঠস্থান তান্ত্রিক দীক্ষা লাভের উপযুক্ত স্থান।
প্রাচীনকালে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটি অবশ্য বর্তমানে দেখতে পাওয়া যায় না। সীতাকুণ্ডের বড় কুমিরায় অবস্থিত কুমিরা খালের আঁকাবাঁকা পথ ধরে আগাতে থাকলে একসময় ধ্বংসপ্রাপ্ত কুমারীকুণ্ড মন্দিরের লাল ইটের দেখা মিলবে। খুব বেশিদিন হয়নি মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। গোষ্ঠবিহারী ধর রচিত সচিত্র তীর্থ-ভ্রমণ-কাহিনী গ্রন্থেও কুমারীকুণ্ড মন্দিরের বর্ণনা পাওয়া যায়।[৩] তবে ঠিক কি কারণে মন্দিরটি ভেঙ্গে পড়ে তা নিয়ে বিস্তারিত জানা সম্ভব হয় না। স্থানীয় কারো মতে, কুমারীকুণ্ড মন্দিরের প্রতিমা চুরি হবার পর মন্দিরটি ভেঙ্গে পড়ে। এরপর থেকে মন্দিরের অবকাঠামোর ধ্বংসাবশেষ নিয়ে কেবল এই কুণ্ডটিই অবশিষ্ট আছে। দুর্গম পথ হওয়ায় ভক্তদের দেখাও তেমন পাওয়া যায় না।
মন্দিরে যাতায়াত:-
কুমারীকুণ্ড শক্তিপীঠে যাওয়ার পথ অতি দুর্গম। এখানে যেতে চাইলে সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন বড় কুমিরা যেতে হবে। বড় কুমিরায় ডাল চাউল মিয়ার মাজারের নিকট থেকে কুমিরা খালের আঁকাবাঁকা পথ ধরে সামনে আগাতে হবে। ঝিরিপথ ধরে সামনে যেতে একসময় একটি প্রাকৃতিক অগ্নিকুণ্ডের দেখা মিলবে। এরপর ঝিরিপথে আরও একটি বাঁক ঘুরলে এই কুণ্ডে যাবার সরু একটু পথ দেখতে পাওয়া যাবে এবং ভগ্ন মন্দিরের অবশিষ্ট লাল ইটের দেখা মিলবে। তবে স্থানীয়দের সাহায্য ছাড়া কুমারীকুণ্ডে যাওয়া বেশ দুঃসাধ্য। স্থানীয়দের কাছে এই কুণ্ডটি গৌরিকুণ্ড নামেও পরিচিত।
Comments
Post a Comment